• শিরোনাম

    বঙ্গ জননী

    আ. ফ. ম. মোদাচ্ছের আলী | রবিবার, ১৩ আগস্ট ২০১৭

    বঙ্গ জননী

    ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের সোপানগুলো যে কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগুতে হয়েছে তার কিছুটা এই কারাগারের রোজনামচা বই থেকে পাওয়া যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন জাতি হিসাবে মর্যাদা বাঙালি পেয়েছে যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই সংগ্রামের অনেক ব্যথা বেদনা, অশ্রু ও রক্তের ইতিহাস রয়েছে। মহান ত্যাগের মধ্য দিয়ে মহৎ অর্জন করে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ডায়েরি পড়ার সময় চোখের পানি বাধ মানে না। রেহানা, বেবী ও আমি চোখের পানিতে ভেসে কাজ করেছি। আজ বেবী নেই তার কথা বার বার মনে পড়ছে। বাংলা কম্পিউটার টাইপ করে নিনু আমার কাজটা সহজ করে দিয়েছে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে কাজ করেছে তার আন্তরিকতা ও একাগ্রতা আমার কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে, তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নিনু যখন টাইপ করেছে তারও চোখের পানি সে ধরে রাখতে পারেনি। অনেক সময় কম্পিউটারের কী বোর্ড তার চোখের পানিতে সিক্ত হয়েছে। আমরা যারাই কাজ করেছি কেউ আমরা চোখের পানি না ফেলে পারিনি।
    তাঁর জীবনের এত কষ্ট ও ত্যাগের ফসল আজ স্বাধীন বাংলাদেশ। এই ডায়েরি পড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার উৎস খুঁজে পাবে। আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধে আব্বা লিখতে শুধু করেন। যতবার জেলে গেছেন আমার মা খাতা কিনে জেলে পৌঁছে দিতেন, আবার যখন মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলো সংগ্রহ করে নিজে সযত্নে রেখে দিতেন। তাঁর এই দূরদর্শী চিন্তা যদি না থাকত তাহলে এই মূল্যবান লেখা আমরা জাতির কাছে তুলে দিতে পারতাম না। বারবার মায়ের কথাই মনে পড়ছে।”
    বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটির ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কথাগুলোই লিখেছেন। এবং যাঁর কথা লিখেছেন তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। একজন শেখ মুজিবুর রহমান থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির পিতা’ হয়ে ওঠার প্রেরণার আধার ছিলেন তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
    এই মহীয়সী মহিলা তাঁর প্রিয়তম স্বামীর আদর্শ ও স্বপ্ন পূরণে জীবনজুড়ে যে ক্লান্তিহীন প্রয়াস চালিয়ে গেছেন তা ইতিহাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। শত দুঃখ–কষ্ট তিনি সয়েছেন হাসিমুখে। কখনোই কারো কাছে এতটুকু অনুযোগ–অভিযোগ করেননি।
    এই বছর রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে সেমিনারে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ঐ অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘রেসকোর্সে যাওয়ার আগে আব্বাকে ভাত খাওয়ার পর আম্মা বললেন– একটু বিশ্রাম নিয়ে যাও। আব্বা বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আম্মা তাঁর মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন– অনেকে অনেক কিছু বলছে, বলবে, কিন্তু তুমি যেটা ভালো মনে করো, তুমি তাই বলবে।” মানুষের প্রধান আশ্রয়স্থল তার পরিবার। যদিও বঙ্গবন্ধুর আশ্রয়স্থল ছিল জনগণ। তবুও বেগম মুজিবের এই সাহসী উচ্চারণ তাঁকে সবসময়ের মতো সেদিনও উদ্ধুদ্ধ করেছিলো। উদ্ধুদ্ধ করেছিলো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণটি জনসমুদ্রে কবিতা ও রণ আহ্বান আকারে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় পৌঁছে দিতে। ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানি শাসকদের।
    টুঙ্গিপাড়া নামের শ্যামল–সবুজ গ্রামে ৮ আগস্ট ১৯৩০ সালে জন্ম নিয়েছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় ও একই বংশধর। সে আমলে শেখ পরিবারে নিজেদের মধ্যেই বিয়ে হত। শেখ জহুরুল হকের দুই কন্যা, শেখ জিন্নাতুন্নেছা আর শেখ ফজিলাতুন্নেছা। ডাক নাম রেণু। তিন বছর বয়সেই রেণু পিতৃহারা হয়। অল্প বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। এই বিয়ের কাজ সমাধা হয়েছিল রেণুুর দাদা শেখ কাশেমের আগ্রহে। বঙ্গবন্ধুর পিতা–মাতা তাঁকে নিজ সন্তানের মতোই লালন–পালন করেন এবং একই পরিবারের সদস্য হিসেবে বড় হতে থাকেন।
    বঙ্গবন্ধুর জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে জেলখানায়। আর সেই সময়গুলোতে পরিবার ও সংগঠনকে যুগপৎভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংগীতপ্রিয় মানুষ। গ্রামের বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল। কিন্তু ঢাকায় অবস্থানকালে পরবর্তী জীবনে বঙ্গবন্ধু বার–বার কারারুদ্ধ হলে অর্থাভাবে বেগম মুজিবকে অনেক গৃহসামগ্রী বিক্রি করতে হয়েছে। ছয় দফা আন্দোলনের সময় তিনি নিজের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে সংগঠনকে আর্থিক সাহায্য করেছেন। কিন্তু গ্রামোফোন ও রেকর্ডগুলো কখনও হাতছাড়া করেননি। ১৯৫৩ সালের ২৮ এপ্রিল শেখ জামাল–এর জন্ম হয়। বেগম মুজিব তখন তিন সন্তানের জননী। গ্রামে থেকে প্রিয়তম মুজিবের খবর নেওয়া যায় না। আজ এই জেলে তো কাল ঐ জেলে। তাঁকে সহায়তা করার মানসে ১৯৫৪ সালে প্রথমবারের মতো পাকাপাকিভাবে তিন সন্তানসহ বেগম মুজিব গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে চলে আসেন। বাসা ভাড়া নেন গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনে। ১৯৫৪ সালে ১০ মার্চের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হলেন। উঠলেন ৩ নম্বর মিন্টু রোডের মন্ত্রীর বরাদ্দ বাড়িতে। কিন্তু ২৯ মে ৯২ (ক) ধারা জারি হলো, মন্ত্রীসভা বাতিল হলো। পুলিশ বাড়িতে বার–বার হানা দিচ্ছে। আর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাদের মোকাবেলা করছেন। ১৪ দিনের সরকারি নোটিশ হাতে নিয়ে এবার উঠলেন নাজিরা বাজারের গলির একটি বাড়িতে। এখানেই জন্ম হলো শেখ রেহানার। বঙ্গবন্ধু জেলে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, স্কুলের বেতন, সংসারে থাকতে হলে এসব তো আছেই। দেশ থেকে শ্বশুর–শাশুড়ি চাল–ডাল আর তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির আয়ের অংশ পাঠাতেন। যা দিয়ে সংসার চালানো ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। কিন্তু কাউকে বুঝতে না দিয়ে চারদিক তিনি সামলাতেন। এই সময় কোনো কোনো দিন রেনু হঠাৎ ছেলেমেয়েদের বলতেন আজ আমরা রুটি খাবো কেমন? রোজ রোজ ভাত মজা লাগে না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে বুঝেছে এ মায়ের খাদ্য তালিকার বৈচিত্র নয়, ভাতের সঙ্গে অন্য কিছু দেবার মতো আর্থিক সঙ্গতি সেদিন মায়ের ছিল না। কি ধৈর্য, সংযম, বুদ্ধি ও আত্মবিশ্বাস ছিল এই দৃঢ়চেতা মহীয়সী নারীর। তা না হলে কি আজকের বঙ্গবন্ধুকে আমরা পেতাম?
    ১৯৫৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব তখনকার কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। রেণু আবার মন্ত্রীর ঘরণী। এবারে উৎসাহ কম। কারণ মন্ত্রী হওয়ার থেকে মন্ত্রীত্ব যাবার অভিজ্ঞতা বেশি। এবারে এলেন ১৫ নং আবদুল গণি রোডে। কিন্তু রেণুর ঘর আর সাজানো হল না। তবে এবারে মুজিবের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ। অতএব আবারও বাড়ি খোঁজা, এলেন সেগুন বাগিচায়। শেখ মুজিব চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণে গেলেন। সংসার যথারীতি গৃহিনীর ঘাড়ে। তবে এরপর কিছু দিন রেণু শান্তি ও স্বস্তি পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন, কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার ভাগ্য নিয়ে রেণু এ সংসারে আসেনি। এ টুকু সুখও সইল না। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারি হল। করাচী থেকে দ্রুত দেশে এলেন মুজিব, ১১ অক্টোবর কারারুদ্ধ হলেন। আবারো বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। কারণ বাড়িটা টি বোর্ডের। শেখ মুজিব কারারুদ্ধ হবার পর দিনই অর্থাৎ ১২ অক্টোবর গৃহ ত্যাগের তিন দিনের নোটিশ হাতে নিলো রেণু। এ বারের বাড়ি খোঁজা আরও কঠিন। কেউ রাজনৈতিক পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। আসবাবপত্র ও সন্তানসহ সব পথে পাগলের মতো বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছেন রেণু। এমন বিপদেও মানুষ পড়ে? ওই মানুষটিকে জেলের ভেতর রেখে দেশেও চলে যেতে পারে না। ওর খবরাখবর নেওয়া শুধু নয়, দলের খবর বাইরের খবর, নির্দেশাবলী মানা ও মানানোর দায়িত্বও ছিল তার। অবশেষে বাড়ি পাওয়া গেল সেগুনবাগিচায় একটি নির্মীয়মান বাড়ির দু’টি কামরা, পানি নেই, ইলেকট্রিসিটি নেই। ওটাই রেণুর বেহেশত। বাড়িওয়ালার কাছে তাঁর কৃতজ্ঞতার সীমা নেই, অন্তত তাকে তার সন্তানদের একটি আশ্রয় তো দিয়েছেন। নাইবা হলো পাকা ঘর। কি আর হবে? জীবন তো রথের চাকা! কখনও শূন্যে ওঠে কখনও মাটি স্পর্শ করে। কিছুদিন চরম কষ্ট করে রেণু এলো ৭৬ সেগুনবাগিচা দোতলা ফ্লাটে। ভাড়া বেশ বেশি। তিনশ টাকা। তবুও ভদ্রভাবে মাথা গুঁজবার ঠাঁই তো হল। রেণু সন্তানদের কোনদিনই এই দুর্দশাকে বুঝতে দেননি। সন্তানদের মাস্টার ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অজুহাত তোমরা ওঁর কাছে ঠিকমত পড়াশুনা করো না, আমিই তোমাদের দেখব। হাসু গান শিখতো, নিঃশব্দে সেমাস্টারও চলে গেলেন। এই সময়টিতে বঙ্গবন্ধুর উপর চৌদ্দটা মামলা ঝুলছে। উকিলের বাড়ি দৌঁড়ানো থেকে শুরু করে কাগজপত্র গোছানো, পার্টি সদস্যদের নির্দেশ পৌঁছানো এসব দায়িত্ব পালন করেছেন এই মহীয়সী নারী। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নিজেকে তৈরি করে ফেলেছিলেন একজন রাজনীতিকের সহযোদ্ধা হিসেবে। আর দশটা সংসারের মতো তার সংসার হবে না সেটা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন।
    পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইউব খান ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করলেন। গণআন্দোলনের মুখে তাঁরা মুক্তি পেলেন এবং প্রদেশের সবকটি রাজনৈতিক দল মিলে সোহরাওয়ার্দী এনডিএফ নামে একটি রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করলেন। কিন্তু এসময় বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু সোহরাওয়ার্দীর কাছে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের অনুমতি চাইলেন। সোহরাওয়ার্দী চিকিৎসার জন্যে লন্ডন ছিলেন এবং ফিরে এসে অনুমতি দিবেন বলে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৈরুতের একটি হোটেলের নির্জন কক্ষে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রিয় নেতার মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধু মুষড়ে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিবের অনুপ্রেরণায় আবার সজীব হয়ে উঠলেন। আওয়ামী লীগ দলটাকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্যে কাজ শুরু করলেন।
    বেগম ফজিলাতুন্নেছা অনেক সময় বঙ্গবন্ধুকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণেও দৃঢ় এবং তেজস্বী ভূমিকা পালন করতেন ও প্রভাবান্বিত করতেন। এই প্রসঙ্গে দুটো স্মরণীয় ঘটনার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে যখন গণঅভ্যুত্থান ক্রমেই দানা বেঁধে উঠছে তখন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান কূটচালের মাধ্যমে গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের শর্তে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের প্রস্তাব দেয়। বেগম মুজিব কারাবন্দী স্বামীর সাথে দেখা করে তাঁকে সতর্ক করে দেন যেন তিনি আইয়ুব খানের ফাঁদে পা না দেন, শর্ত মেনে সহবন্দীদের ফেলে রেখে মুক্তি নিয়ে একা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে না আসেন। স্বামীর মুখের ওপর তিনি সেদিন বলেছিলেন ‘দ্যাখো, আমি তোমার স্ত্রী। তুমি মুক্তি পেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসো সেটা আমার চেয়ে নিশ্চয় আর কারো বেশি কাম্য হতে পারে না। কিন্তু তুমি যদি তোমার সাথে যারা বন্দি তাদের কারাগারে রেখে শর্তাধীনে একা বেরিয়ে আসো তাহলে আমিই তোমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো।’ যদিও বঙ্গবন্ধু এ কাজ করতেন না। এমনি নির্ভীক ও তেজস্বী ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা। বঙ্গবন্ধুর উপযুক্ত সহধর্মিনী–ই বটে। ১৯৭১ সালের ২৩ কি ২৪শে উত্তাল মার্চ। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সাথে আলোচনা চলছে বঙ্গবন্ধুর। আকস্মিকভাবে গুজব রটলো সমঝোতার ফর্মূলা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোর দলের মধ্যে কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে পাক সামরিক জান্তা। বেগম মুজিব আবারো দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালেন স্বামীর মুখোমুখি, বললেন ‘যা শুনছি তুমি যদি তাতে রাজি হও তাহলে আমি আর ধানমণ্ডির এই বাসায় থাকবো না। আমাকে টুঙ্গীপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিও। যে বাড়িতে জনগণ আসে বুকভরা আশায় আন্দোলিত হয়ে, সেই বাড়ি লক্ষ্য করে অতঃপর ইট–পাটকেল পড়ুক এটা আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারবো না।” যোগ্য নেতার যোগ্য স্ত্রীর মতোই কথা বলেছিলেন তিনি। কারণ তিনিও জানতেন বঙ্গবন্ধু এই ফাঁদে পা দিবেন না।
    মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বেগম মুজিব ছিলেন গৃহবন্দী। পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু অন্তরীণ সামরিক জান্তা তাঁকে ফাঁসিতে চড়ানোর পাঁয়তারা করছিল। সেই দুঃসময়েও তিনি ধৈর্য্য ধরেছেন। অপেক্ষা করেছেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দরে মানুষের ঢল নামে। মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা জাতীর ও নিজের এই নায়ককে তখনও একান্ত সান্নিধ্যে পাননি। বত্রিশ নম্বর বাড়িতে তাঁকে গভীরভাবে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন। তাও ক্ষণিকের জন্য। এরপরে তো বঙ্গবন্ধু নেমে পড়েন দেশ গঠনের কাজে। প্রিয় মানুষকে কাছে পাওয়া হয় না। তবুও তার কোনো আফসোস ছিল না। কিন্তু ১৫ আগস্টের সেই নির্মম কালো রাতে ঘাতকদের বুলেট ঝাঁঝড়া করে দেয় এই মহিয়সী নারীর দেহ। একটুও কাঁপেনি হাত তাদের। কিন্তু ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনি। জীবনের ঝুঁকি, কণ্টকাকীর্ণ পথ, পদে পদে বিপদ, আর্থিক অনটন সব বোঝা মাথায় নিয়ে যে মানুষটি আমাদেরকে একজন ‘বঙ্গবন্ধু’ তৈরি করে দিয়েছেন তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আজীবন তাঁকে স্মরণ করব।
    এই মহীয়সী নারী তাঁর প্রিয়তম স্বামীর আদর্শ ও স্বপ্ন পূরণে যে ক্লান্তিহীন প্রয়াস চালিয়ে গেছেন তা বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য নজির। বিদ্রোহী কবির ভাষায় – ‘‘রাজা করেছে রাজ্য শাসন/ রাজারে শাসিছে রাণী/ রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে/ রাজ্যের যত গ্লানি।’’ তিনিও তাই।
    লেখক: প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক।
    (সংগৃহীত)

    Comments

    comments

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    সবটুকুই সত্য

    ১৮ জুন ২০১৭

    আর্কাইভ

  • ফেসবুকে চিনাইরবার্তা.কম