• শিরোনাম

    শারদীয় দূর্গোৎসব উপলক্ষে প্রসন্ন দাস সম্পাদিত পত্রিকায় লেখা;

    শারদীয় সম্প্রীতিতে হোক অশুভ শক্তির বিনাশ

    আল আমীন শাহীনঃ | শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

    শারদীয় সম্প্রীতিতে হোক অশুভ শক্তির বিনাশ

    নাফ নদীর স্বচ্ছ জলে এখন রক্তের ধারা। নদীতে ভাসছে সৃষ্টির সেরা মানুষের মরদেহ, রক্তাক্ত ,খন্ডিত বিকৃত। বাতাসে পচা পোড়া দগ্ধ লাশের গন্ধ। রোহিঙ্গাদের চোখের জল নাফ নদীকে করেছে উত্তাল। নদী তীরে অসহায় মানুষের হাহাকার। মায়ানমারে নৃশংস বর্বরতা, ধিক্কার দিচ্ছে মানব সভ্যতাকে। স্বজনহারা,ঘর হারা,জন্মস্থান হারা, দেশ ছাড়া লাখ লাখ নারী পুরুষ শিশুর মাতম কান্নাবিলাপ শান্তি স্বস্তি অধিকারের জন্য মানবতার দুয়ারে কড়া নাড়ছে। শোকাহত নির্যাতিত নিপীড়িত সবহারা মানুষ বুকে জমা কষ্ট বেদনা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই সময়ে চাইছে দুঃসময়ের পরিত্রাণ আর অশুভ শক্তির বিনাশ।
    জীবনের এই বাঁকে এসে সাম্প্রতিক মায়ানমারে ঘটে যাওয়া দুঃসহ অপ্রত্যাশিত নানা ঘটনায় মর্মাহত আমি। বেশী ব্যথিত হলে, অর্থদাসত্ব আর যান্ত্রিত ব্যতিব্যস্ত জীবনে ক্লান্ত হলে মাঝে মধ্যে প্রকৃতির কাছে আমি খুঁজি শান্তি স্বস্তির আশ্রয়। প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য মনকে করে প্রফুল্ল, অন্তরের ব্যথা-বেদনা ক্ষণিকের জন্য হলেও বিলীন হয়। তাই মাঝে মধ্যে প্রকৃতিতে মিশে যাই। এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই।
    যাচ্ছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর বাইপাস সড়কের পাশ দিয়ে। সড়কের পশ্চিম প্রান্তে খোলা মাঠে চোখে পড়লো কাশফুলের বড় ক্ষেত্র আর কমল-ধবল রূপ। দেখলাম আশপাশে বর্ষণ-বিধৌত সবুজের সমোরোহ, মেঘ মুক্ত আকাশে সাদা মেঘের অলস-মন্থর নিরুদ্দেশ যাত্রা। এদিক সেদিক ভাসছে মেঘের ভেলা। এই দৃশ্যে মনে পড়লো এখনতো শরত, তাই প্রকৃতিতে ঋতু রাণী শরতের রূপের রঙ্গমেলা। বর্ষার অবসানে স্নিগ্ধ-শান্ত শরত এসেছে। বন-উপবনে পুষ্পের ছড়াছড়ি,শিউলী ও কামিনী ফুলের সুভাস ও সৌন্দর্য নয়ন-মনকে মুগ্ধ করার সময়। এখনতো সময় প্রভাতের তৃণ-পল্লবে নব-শিশিরের আল্পনার। মনে বেজে উঠলো হঠাৎ ঢাক- ঢোল, কাশির মন্দিরার বাদন, উল্লাস আনন্দ, উলুধ্বনী, মানসপটে শারদীয় দূর্গোৎসবের ব্যাপক আয়োজন। এই সময়েইতো সনাতন ধর্মীদের প্রধান উৎসব শারদীয় দূর্গোৎসব। আমার জীবনের শৈশব কৈশোর আর যৌবনের নানা স্মৃতি এই দূর্গোৎসবকে ঘিরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের তিতাস পাড়ের কালাইশ্রীপাড়া, পাইকপাড়ায় নানা বিচরণে ক্রমশ বেড়ে উঠেছি আমি। এসব পাড়ার বাসিন্দারা অধিকাংশই সনাতনধর্মাবলম্বী। তাদের পূজাপার্বন উৎসব আয়োজনে সম্পৃক্ততার পুলকিত নানা অধ্যায় আমার মনে অম্লান। দুপাড়ার পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদীতে প্রতিদিনের গোসল, সাঁতার, জলে ভেসে দাপাদাপি লাফ ঝাঁপ,রায়বাড়ির আঙ্গিনা মাঠে প্রতিদিনের নানা খেলা,জগৎবাবুর বাড়ির সামনে পুকুরে ডুব সাঁতার,গুরুচরণ আখড়ার সামনের পুকুরে ভেসে থাকা নানা কিছু। এখানে আমার শৈশব কৈশোরের খেলার সাথী বন্ধু সমবয়সী স্বপন রায়, লিটনদেব,জগদীশ, অনুপ, দীপন, নারায়ণ, নিত্যানন্দ, মহিতোষ, জয়জিৎ, রতন, গৌতম, সুবল, খোকন,মিঠু,মনু ,অসীম, সুনীল ধীমান, মাধুরী,রেবা, পূরবী, মণি,স্বরসতী, অনিমা, মণিকা গীতা সহ অনেকে। সময়ের ব্যবধানে কেউ দূরে কেউ কাছে থাকলেও হৃদবন্ধনে তাদের অবস্থান সবসময় মনের গহীনে। এই কালাইশ্রীপাড়া গুরুচরণ আখড়ায় বর্নাঢ্য আয়োজনেই হয় শারদীয় দূর্গোৎসব। জীবন শুরুতে উৎসব আমেজের দেখা মিলে এখানেই। আমার সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার অনন্য ক্ষেত্র এ স্থান। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার সূচনা সময় এখানেই কাটিয়েছি, এখানকার সকলের সৌহার্দ সম্প্রীতি আর ভালবাসায়। শারদীয় দূর্গোৎসব মনে হলেই কালাইশ্রীপাড়ার কাটানো সময় ভেসে উঠে। ৫ দিন ব্যাপী মূল উৎসবে নানা অধ্যায়ে,গভীর রাতে সবার সাথে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত আনন্দে মিশে থাকা স্মৃতিময় সময় ভুলতে পারিনা। এসবই মনে পড়ছে কাশবনের পাশে দাঁড়িয়ে।
    দূর্গোৎসব ঐতিহাসিকভাবে বাঙালির অনন্য সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবের আমেজে এক সুন্দর সম্প্রীতির পরিবেশের সৃষ্টি করে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে দুর্গাপূজার প্রধান আবেদন হলো, ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’, অর্থাৎ সব অশুভ শক্তিকে নির্মূল করার জন্যই পৃথিবীতে প্রতিবছর দেবী দুর্গার আগমন হয়। প্রাচীনকাল থেকেই বছরের চৈত্র মাসে বসন্তকালে বাসন্তী নামে পৃথিবীতে দেবী দুর্গা আবির্ভূত হন, যা হিন্দু সম্প্রদায়ে বাসন্তী পূজা হিসেবে উদযাপন করা হয়। রাক্ষস রাজা রাবণ রামচন্দ্রকে যুদ্ধে পরাভূত করার জন্য কৌশল হিসেবে তাঁর সহধর্মিণী সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যায়। রামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধারের জন্য শরৎকালে অকালবোধনের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে আবাহন করেন। তখন থেকেই শরৎকালে এই শারদীয় পূজার প্রচলন শুরু। ভক্তরা বাসন্তী মায়ের আরাধনা করেন সব প্রাণীর দুঃখ-দৈন্য, অভাব-অনটন, রোগমুক্তি, অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার দূর করে, মানুষের তথা দেশের সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তিময় জীবনের আশায়। শারদীয় উৎসবের উদ্দেশ্য একই, তবে বাসন্তী পূজার তুলনায় শারদীয় সর্বজনীনতা ও উৎসবের ব্যাপকতা অনেক বেশি। শরতের শিশিরভেজা শিউলি ফুলের গন্ধ, কাশফুলের শুভ্রতা, আকাশজুড়ে শরতের সাদা মেঘ সবই যেন দেবী দুর্গার আগমন বার্তা নিয়ে আসে ভক্তদের মধ্যে। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় দেবীকে বরণ করে নেওয়ার আয়োজন। দুর্গাপূজার সর্বজনীনতা সবার কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও জনপ্রিয়। দেবী দুর্গা তাঁর সন্তান লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক ও স্বামী ভগবান মহেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে মর্ত্যে আগমন করেন। অসুর শক্তি নিধনের প্রতীকী মূর্তিতে সবাই দেবী দুর্গাকে মহিষাসুর বধ করার দৃশ্যে দেখতে পায়। কে কত সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এ নিয়ে বিভিন্ন পূজান্ডপের আয়োজকদের মধ্যে শুরু হয় তুমুল প্রতিযোগিতা। প্রতিমার মৎৃিশল্পীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা শুরু হয় কে কত সুন্দর ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করে আয়োজকদের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেন। বিভিন্ন ধর্ম বর্নের শ্রেণি-পেশার মানুষ বাঙালি হিন্দু ঐতিহ্যের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজায় মন্ডপে যায় এবং এর মধ্য দিয়ে ধর্মে – বর্ণে, গোত্রে গোত্রে ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে এক মহা মিলনমেলার সৃষ্টি হয়। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন হয় দৃঢ় । ভক্তদের বিশ্বাস দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনী হিসেবে প্রতিবছর ভক্তদের সামনে আবির্ভূত হন। দশভুজা দেবী ১০ হাতে সব অপশক্তির কবল থেকে মানুষকে মুক্তি দেন এবং মানবকল্যাণে সব ধরনের অগ্রযাত্রা প্রতিষ্ঠিত হয়।
    কাশবনের শ্বেত শুভ্রতায় প্রকৃতির মুগ্ধতায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম শারদীয় দূর্গোৎসবের নানা স্মৃতিতে। জীবিকার তাগিদেই আবারও কর্মব্যস্ততা। শত ব্যস্ততার মাঝেও মনে মনে প্রত্যাশা করি এবারের শরত সময়ে সকলের মন থেকে হিংসা ঘৃণা বিদ্বেষ হানাহানি পাশবিকতা নির্মূল হোক। শরতের প্রকৃতির রূপ লাবণ্যের মতোই সুন্দর হোক সকলের মন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে অশুভ শক্তির বিনাশ হয়ে শান্তি, সত্য ও সুন্দরের আরাধনা হোক সকলের। নাফ নদীতে বহমান থাকুক স্বচ্ছ পানির ধারা,বিশ্বের সর্বত্রই সকল ধর্ম ও বর্নের মানুষের শান্তিতে থাকার অধিকার সুনিশ্চিতের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে হোক সকলের প্রার্থনা।

    লেখক: সিনিয়র সহ সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব। সম্পাদক নতুনমাত্রা।

     

    Comments

    comments

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    সবটুকুই সত্য

    ১৮ জুন ২০১৭

    বঙ্গ জননী

    ১৩ আগস্ট ২০১৭

    আর্কাইভ

  • ফেসবুকে চিনাইরবার্তা.কম