• শিরোনাম

    রবীন্দ্রনাথের কবিতা : মানবসত্যের বরাভয়

    মহিবুর রহিম | শনিবার, ০৬ মে ২০১৭

    রবীন্দ্রনাথের কবিতা : মানবসত্যের বরাভয়

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এক বিস্ময়কর বহুমুখী প্রতিভা। বাংলা সাহিত্যের বিশাল প্রান্তর তিনি আপন যোগ্যতা বলে ফুলে-ফলে ভরে তুলেছেন। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তাঁর সৃজনশীল দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায় না। কবিতা, গল্প,উপন্যাস, সঙ্গীত, নাটক, কাব্য-নাটক, গীতিনাট্য, পত্র, প্রবন্ধ, সমালোচনা, এমন কি চিত্রশিল্পেও তাঁর অসামান্য যোগ্যতার প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন। তথাপি কবি হিসাবেই রবীন্দ্রনাথের প্রধান পরিচয় সুবিদিত। মাত্র আট বছর বয়সে কবিতা রচনায় তাঁর হাতেখড়ি ঘটে। স্বভাবসুলভ জীবনজিজ্ঞাসা, বিশ্বপ্রকৃতি, প্রকৃতির সৌন্দর্য ও নিয়ম, অধ্যাত্মপ্রেম, নিঃসঙ্গতা, চিরায়ত জীবনদর্শন, দুঃখবোধ, আনন্দ ও আত্মজাগরণ জীবনের এমনি প্রাত্যহিক বিষয়গুলো তাঁর কাব্যচেতানায় মূর্ত হয়ে ওঠে। সেই শৈশব থেকে জীবনের সারসত্য সন্ধানে রবীন্দ্রনাথ নিমগ্ন হন এবং প্রতিটি অনুভব, অনুপ্রেরণা ও অনুশোচনাকে তিনি কাব্যে উত্তীর্ণ করেন। জীবনের দীর্ঘ পরিক্রমা শেষে আশি বছর বয়সে সাহিত্য ও শিল্পের সকল শাখায় নিজ যোগ্যতার প্রমাণ রেখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বেও তিনি পৃথিবীর মানুষের জন্য শেষ দান হিসেবে রেখে যান কবিতার কিছু উজ্জ্বল পংক্তি। শুরুতে যে কৌতুহলী জিজ্ঞাসা তাঁকে আন্দোলিত করেছিল, ভর যৌবনে তা আশার তরীতে ভ্রমণশীল আর জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে শেষ হয়েছে জীবনের কঠিন সত্য উন্মোচনে। পৃথিবীতে মানুষের নির্ভয় মনে বেঁচে থাকার জন্য অফুরান আশ্বাসবাণীকেই তিনি জীবনের সারসত্যরূপে মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন। শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে আবার কবিতা দিয়েই টেনেছেন তিনি যবনিকা।
    নেহায়েত শৈশবেই রবীন্দ্রনাথ কাব্য রচনায় নিমগ্ন হন। কিন্তু কবি প্রতিভার প্রকৃত উন্মেষ ঘটে “প্রভাত সংগীত” (১২৯০) রচনাকালে। রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক কাব্য চেতনার আশ্চর্য স্ফুরণও লক্ষ্য করা যায় এ কাব্য গ্রন্থে।

    ‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি!
    জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি!
    ধরায় আছে যত মানুষ শত শত
    আসিছে প্রাণে মোর, হাসিছে গলাগলি।
    …………………………………….
    প্রভাত হল যেই কী জানি হল এ কী!
    আকাশ পানে চাই কী জানি কারে দেখি!
    প্রভাত বায়ু বহে কী জানি কী যে কহে,
    মরম মাঝে মোর কী জানি কী যে হয়!….
    (প্রভাত-উৎসব/প্রভাত সংগীত)
    আজি এ প্রভাতে রবির কর
    কেমনে পশিল প্রাণের পর,
    কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান!
    জানি না কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
    জাগিয়া উঠিছে প্রাণ,
    ওরে উথলি উঠিছে বারি,
    ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।
    (প্রভাত-উৎসব/প্রভাত সংগীত)
    আত্মজাগরণ ও অনুভবের অসাধারণ প্রেরণা আছে এসকল কবিতায়। এর অল্প কিছু কালের মধ্যেই ‘কড়ি ও কোমল’ (১২৯৩) এ দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের কাব্য ভাবের পূর্ণচ্ছটা যেন ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে কবিকে পাওয়া যায় এক গীতিপ্রবণ ভাবুক কবি রূপে। জীবন ও প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ কবিকে উচ্ছ্বসিত করেছে। অকারণ অবারণ এ উচ্ছ্বাস কিন্তু প্রগাঢ় জীবনপ্রেমে সংরক্ত।
    ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
    মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
    এই সূর্য করে এই পুষ্পিত কাননে
    জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।
    (প্রাণ /কড়ি ও কোমল)
    কিন্তু ‘মানসী’তে এসে রবীন্দ্রনাথের কবি কল্পনার উন্মুক্ত উৎসারণ ঘটে। কবির ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি নিজস্ব মাত্রা লাভ করে। ‘মানসী’ (১২৯৭) কাব্যের সৌন্দর্যব্যাকুলতা ‘সোনার তরী’ (১৩০০) কাব্যে এসে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের প্রতি কবির সীমাহীন উৎসুক্যে মন্ময় হয়ে উঠে। অপরদিকে ‘চিত্রা’ (১৩০২) কাব্য কবিকে প্রতিষ্ঠিত করে কাব্য সার্থকতার পূর্ণ শিখরে। ‘চিত্রা’তেই দেখা গেল কবির ব্যক্তিত্ব ও কাব্যচেতনা গতিশীল এবং ক্রম পরিণতির অভিমুখে ধাবমান। এ কাব্যের ‘উর্বশী’ কবিতায় ধ্রুপদী ভারতীয় সাহিত্যের ভাবধারায় এক চিরবিরহী আত্মার ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে।

    ‘তাই আজি ধরাতলে বসন্তের আনন্দ উচ্ছ্বাসে
    কার চিরবিরহের দীর্ঘশ্বাস মিশে বহে আসে,
    পূর্ণিমা নিশিথে যবে দশদিকে পরিপূর্ণ হাসি,
    দূর স্মৃতি কোথা হতে বাজায় ব্যাকুল করা বাঁশি
    ঝরে অশ্রুরাশি।”

    কিন্তু ‘এবার ফেরাও মোরে’ কবিতায় বাস্তবতার আহ্বানে কবি সাড়া দেন। নিজের মধ্যে এক সামাজিক সত্যকে তিনি উপলব্ধি করেন।

    ‘সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত,
    তুই শুধু ছিন্ন বাঁধা পলাতক বালকের মতো
    মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণœ তরুচ্ছায়ে
    দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে
    সারাদিন বাজাইলি বাঁশি। ওরে তুই ওঠ আজি
    আগুন লেগেছে কোথা! কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
    জাগাতে জগৎ জনে!’
    অপার্থিব সৌন্দর্যপ্রেম, বিরহ, হৃদয়ের নিগূঢ় আলোড়ন থেকে ক্ষুধার্ত নিপীড়িত মানুষের ক্রন্দনধ্বনি রবীন্দ্র সাহিত্যে একটি বিশেষ মাত্রা নিয়ে আসে। কিন্তু এ চর্চা রবীন্দ্রনাথ অসমাপ্ত রেখেই জীবন সত্যের মরমি চিন্তায় অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন। আমরা দেখি ‘চৈতালী’ (১৩০৩), ‘কণিকা’ (১৩০৬), ‘কল্পনা’ (১৩০৭), ‘ক্ষণিকা’ (১৩০৭), ‘নৈবেদ্য’ (১৩০৮) প্রভূতি কাব্যে বিচিত্র বিষয় ও অনুভব রোমান্টিক নান্দনিকতায় জারিত হয়ে বাংলা কাব্যজগৎকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। শুরুতে গীতিধর্মী প্রবণতাই ছিল রবীন্দ্রকাব্যের মূলসুর। শেষাবধি এ সুরই রবীন্দ্র কাব্যচেতনাকে প্রাণপূর্ণ করে রেখেছে। ‘গীতাঞ্চলি’ (১৩১৭) থেকে ‘গীতালি’ (১৩২১)- এ পর্বে রবীন্দ্রনাথের গীতি প্রবণতা ভাবে, বিষয়ে ও নবতর সুরের সাধনায় উৎকর্ষতার শীর্ষচূড়া স্পর্শ করেছে। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের জন্য ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনিই প্রথম একজন এশিয়ান সাহিত্যের জন্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। বিশ্ব বিধাতার কাছে মানুষের ব্যাকুল প্রার্থনা ও সুনির্মল প্রত্যাশার এক অসাধারণ বাণীশিল্প রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’। সুদূরের পিয়াসী, অসীমের সুরসন্ধানী, শুদ্ধতাভিসারী এবং অধ্যাত্মবাদী রবীন্দ্রনাথের কবি মানসের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে ‘গীতালি’ পর্বের কবিতাসমূহে। এখানে সৌন্দর্যমুগ্ধ কবি হৃদয়ের সমস্ত চঞ্চলতা আত্মনিবেদনের ঐকান্তিক আগ্রহের মধ্যে স্থির ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
    রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাধনার একটি বড় অংশ জুড়ে তাঁর অধ্যাত্ম ভাবনা শ্যামল ছায়া বিস্তার করে আছে। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে তাঁর অনুসন্ধিৎসু চৈতন্য এক বিশেষ ভাবলোক গড়ে নিয়ে নিজেকে চেনার এবং স্রষ্টাকে জানার চেষ্টায় রত।

    ‘রূপ সাগরে ডুপ দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি,
    ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।’

    রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রতিষ্ঠা ঘটালেন প্রথাগত ধর্মবন্ধনমুক্ত এক উদার মানবীয় চিন্তার। কিন্তু এটিই রবীন্দ্র কাব্যের মূল সুর নয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁর গীতলতা। গীতি কবির পরিচয়ে রবীন্দ্রনাথকে তাই আন্তর্জাতিকভাবেই সনাক্ত করা হয়ে থাকে। আধুনিক রোমান্টিক সাাহিত্যের তিনি এক শীর্ষ সাফল্যের প্রতীক। অকারণ, অবারণ ভাবের উচ্ছ্বাস তাঁর সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল কল্পনার ঐশ্বর্য।
    রবীন্দ্রকাব্যে নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটে তাঁর ‘বলাকা’ (১৩২৩) পর্বের কবিতাগুলোতে। জীবনের বিপুল অভিজ্ঞতা, বিদেশ ভ্রমণের অভিনিবেশ, যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর উত্থান পতনের অভিঘাত কবি মনে নতুন চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। প্রথমবার ইউরোপ সফরকালেই রবীন্দ্রনাথ নতুন বৈশ্বিক চিন্তার মুখোমখি হন। বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক বার্গসঁ’র গতিতত্ত্ব তাঁর চিন্তাধারায় প্রভাব ফেলে। কবি জীবন ও জগৎকে এক অনশ্বর গতির মধ্যে উপলব্ধি করেন। ‘বলাকা’ কাব্যের-‘শাজাহান’, ‘চঞ্চলা’, ‘বলাকা’ প্রভৃতি কবিতায় এই গতিবাদ দারুণ স্ফুর্তি লাভ করেছে। যেমন ‘বলাকা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ঃ

    ‘এ পাখার বাণী, দিল আনি
    শুধু পলকের তরে
    পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
    বেগের আবেগ
    পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ।’

    কিংবা রবীন্দ্র কাব্যে চির উৎকর্ষতার মহিমাধারী ‘শাজাহান’ কবিতায় দেখা যায় :
    ‘এ কথা জানিতে তুমি ভারত ঈশ্বর শাজাহান
    কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান
    হায় ওরে মানব হৃদয়
    বার বার
    কারো পানে ফিরে চাহিবার
    নাই যে সময়’
    রবীন্দ্র কাব্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন লক্ষ্যে করা যায় ১৯৩২ সালে প্রকাশিত ‘পুনশ্চ’ (১৩৪৯) কাব্যগ্রন্থ থেকে। এরপর রবীন্দ্রনাথ আর সমিল কবিতা রচনায় ফিরে যাননি। অধিকাংশই লিখেছেন মুক্তক অথবা নিরেট গদ্যছন্দে। দেখা যায় বিষয়বস্তুতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। মাটির কাছাকাছি অবস্থানরত মানুষ এবং তাদের সমস্যা কিংবা নতুন যুগের বিষয় অথবা যুগের সংশয় প্রাধান্য বিস্তার করে আছে এ পর্বের কবিতায়।
    দীর্ঘকালের সাহিত্য জীবনে রবীন্দ্রনাথ সমকালীন বাংলা কবিতার মুক্তি নিশ্চিত করেছেন। আঙ্গিক, ভাব, বিষয়, অনুভব তথা সব দিক থেকেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পুরণোকে অতিক্রম করে গেছে। কৈশোরে আত্মকেন্দ্রিক উপলব্ধি নিয়ে যে কবিতাচর্চার শুরু-পরিণত বয়সে বিশ্বজনীন মানবতাবোধে উত্তরণের মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। রবীন্দ্রনাথের কর্মাদর্শ সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাবার জন্যে আমাদের ফিরে যেতে হবে রবীন্দ্রনাথের নিজের বক্তব্যের কাছে:
    ‘আমি ভালবেসিছি এই জগৎকে। আমি প্রণাম করেছি মহৎকে। আমি কামনা করেছি মুক্তিকে-যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদন। আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য, সেই মানবের মধ্যে তিনি সদা জনানান হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট।’

    লেখকঃ মহিবুর রহিম: কবি ও প্রাবন্ধিক। সিনিয়র প্রভাষক বাংলা, চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজ।

    সম্পাদনায়ঃএম.আমজাদ চৌধুরী রুনু

    Comments

    comments

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    সবটুকুই সত্য

    ১৮ জুন ২০১৭

    বঙ্গ জননী

    ১৩ আগস্ট ২০১৭

    আর্কাইভ

  • ফেসবুকে চিনাইরবার্তা.কম