• শিরোনাম

    ফিরে দেখাসিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পূর্বদেলুয়া গ্রামের অনিল চন্দ্র শীলের মেয়ে পূর্ণিমা রানী শীল।

    বিশেষ রিপোর্ট | শনিবার, ০৩ জুন ২০১৭

    ফিরে দেখাসিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পূর্বদেলুয়া গ্রামের অনিল চন্দ্র শীলের মেয়ে পূর্ণিমা রানী শীল।

    সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পূর্বদেলুয়া গ্রামের অনিল চন্দ্র শীলের মেয়ে পূর্ণিমা রানী শীল। চার বোন ও পাঁচ ভাইসহ বাবা-মায়ের সংসার ছিল সুখের। হেসে আনন্দে
    কাটছিল ওদের জীবন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর দেশে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সদ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতেছে বিএনপি চার দলীয় জোট। দেশব্যপী চলছে তাদের আনন্দ-উল্লাস। সেই আনন্দ-উল্লাসের ভয়ঙ্কর শিকার বহু হিন্দু পরিবার।
    এর মধ্যে অন্যতম আলোচিত ঘটনাটি ঘটে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। ঐ গ্রামে বসবাসকারী একটি হিন্দু পরিবারে। যাদের কিশোরী কন্যাটি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী, বিএনপি-জামাত জোটের ছাত্রনেতাকর্মীদের গণধর্ষণের শিকার হয়। অই ঘটনায় দেশের সমস্ত মিডিয়া ও সামাজিক মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। সে সময় উল্লাপাড়া থানায় মামলা দায়ের হয় ১৭ জন আসামীর বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা বিএনপির নেতাকর্মী বলে তখনকার থানার কর্মকর্তা ও পুলিশ কোনও এ্যাকশন নেয়নি তাদের বিরুদ্ধে। তাই পরে আবারও মামলা করা হয় সিরাজগঞ্জের আমলি আদালতে।

    সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমাকে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ের পর হিন্দু হওয়ায় এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার অপরাধে বিএনপির কয়েকজন স্থানীয় ক্যাডারের দারা গণধর্ষনের শিকার হয়। নবম শ্রেণীতে পড়া পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করতে এসেছিলো ১০-১২ জনের একটি দল। এতোটুকুন মেয়েটা এতজনের অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না দেখে পূর্ণিমার মা কান্না করতে করতে বলেছিলেন, \”বাবা\’রা আমার মেয়েটা ছোট… মরে যাবে। তোমরা একজন একজন করে আসো।\”
    এতকিছুর পরেও দৃঢ় মনোবল আর নিজের প্রতি অবিচল আস্থায় সব বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন উল্লাপাড়ার বহুল আলোচিত নির্যাতিত পূর্ণিমা। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিজয়ী হওয়ার পর অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছিল তার জীবন ও পরিবারের ওপর। সেই পূর্ণিমা প্রত্যন্ত গ্রামের পিছিয়ে থাকা বড় পরিবারটিকে একাকী ধীরে ধীরে টেনে তুলছেন। নিজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ভাইবোনদেরও শিখিয়েছেন লেখাপড়া। মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে তাদের। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানো এই মেয়েটি ১৭ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন যন্ত্রণার জ্বালাও। তবে সাহসী পূর্ণিমা বলেন, \’লজ্জা আমি পাব কেন? এই লজ্জা সমাজের, রাষ্ট্রের।\’
    যা ঘটেছিলো সেদিন
    পূর্ণিমা সে সময় উল্লাপাড়া হামিদা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। বয়স ১৪ বছর। ভোটের দিন সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জা পূর্বদেলুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে তার দলের মহিলা এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছিলেন পূর্ণিমাকে। বিএনপি প্রার্থী এম আকবর আলীর কর্মী ও সমর্থকরা ভোট চলাকালে জোর করে কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপার নিয়ে ধানের শীষে সিল দেওয়ার চেষ্টা করেন।
    এ সময় প্রতিবাদ করেন এই সাহসী মেয়ে। বচসা হয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে। বিষয়টি উপজেলা নির্বাচন অফিস ও প্রশাসনকে অবহিত করেন তিনি। এটাই ছিল পূর্ণিমার অপরাধ। ওই নির্বাচনে হেরে যান আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল লতিফ মির্জা।
    নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর ৮ অক্টোবর বিএনপি জোটের নেতা ও সমর্থক মিলে দেড় শতাধিক মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে সন্ধ্যার পর আকস্মিক হামলা চালায় পূর্ণিমাদের বাড়িতে। ১৫-২০ যুবক বাড়ি থেকে পূর্ণিমাকে জোর করে তুলে পাশের মাঠে নিয়ে যায়। এখানে তার ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। আক্রমণকারীরা পূর্ণিমার বাবা, মা, ভাইবোনদের বেধড়ক পেটায়। পূর্ণিমার মায়ের ডান হাত ভেঙে যায়। গুরুতর আহত হন তার বাবা অনিল শীল, মেঝো বোন গীতা রানী শীল, ভাই গোপাল চন্দ্র শীল ও অর্জুন শীল। সন্ত্রাসীরা লুটপাট চালায় তাদের বাড়িতে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের বাড়ি।
    সেদিনের ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া সাক্ষাতকারে পূর্ণিমা শীল জানান, ওই সময় উল্লাপাড়া থানায় কর্মরত উপ-পরিদর্শক মো. ইকবাল মাঠ থেকে তাকে উদ্ধার করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম তাকে কোলে করে নিয়ে বাড়ির পাশের রাস্তায় ভ্যানে তোলেন। উল্লাপাড়া থানায় মামলা দেওয়ার ব্যাপারে আব্দুল লতিফ মির্জার সঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শফি, সিরাজগঞ্জের সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, উল্লাপাড়া হিন্দু ধর্মীয় নেতা গৌতম কুমার দত্তসহ অনেকেই তাদের সাহায্য করেন। আমিনুল ইসলাম চৌধুরী উল্লাপাড়া ২০ শয্যা হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য তাকে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। পূর্ণিমা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ওই সময় পূর্ণিমার বাবা অনিল চন্দ্র শীল বাদী হয়ে উল্লাপাড়া থানায় ১০ অক্টোবর মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও লুটপাটের মামলা দায়ের করেন।
    পূর্ণিমা তার অতীত ও বর্তমান কাহিনীর বিবরণ দিতে গিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারের চরম
    দুর্দিন ও অসহায় অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী উল্লাপাড়ার আদর্শগ্রামে তাদের বসবাসের জন্য পাঁচ শতক জমি দিয়েছেন। ঘর তুলে দিয়েছেন। তাকে
    একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি দিয়েছেন। তার ভাই গোপাল চন্দ্র শীলকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। লেখাপড়া করার সুযোগ করে দিয়েছেন
    পূর্ণিমার। তিনি প্রধানমন্ত্রীর এ অবদানের কথা কোনোদিন ভুলবেন না।
    পুর্নিমা জানান, ২০০১ সালের ঘটনার পর প্রতিপক্ষের লোকজন রাখাল চন্দ্র শীল নামের তার এক ভাইকে রাস্তায় চরম মারধর করে। এ সময় তার দুই চোখেও আঘাত করা হয়। শেষ পর্যন্ত অন্ধ হয়ে যায় সে।
    পূর্ণিমা বলেন, জোট সরকারের সময় তার বাবার করা মামলা নিয়ে পুলিশ টালবাহানা শুরু করেছিল। ফলে ২০০১ সালেরই ২৪অক্টোবর পূর্ণিমা রানী শীল ১৬ জনকে আসামি করে সিরাজগঞ্জ জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে আবারও মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় পুলিশ ২০০২ সালের ৯ মে ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করে।
    পরে আদালত ওই অভিযোগপত্র আমলে না নিয়ে আবারও চার্জশিট দেওয়ার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ দ্বিতীয় দফায় ১১ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়। আদালতের ২০১১ সালের ৪ মে অভিযুক্ত ১১ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সে সঙ্গে এক লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর করে সাজা দেন। তাদের মধ্যে ছয় জন রয়েছেন জেলে।
    পুর্নিমাকে ধর্ষণে অভিযুক্ত আসামিরা
    তবে এই মামলার রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি পূর্ণিমা।
    তিনি বলেন, মামলার রায়ে সবার না হলেও অন্তত ১ ও ২ নম্বর আসামি তার গ্রামেরই বাসিন্দা আলতাব হোসেন ও আব্দুল জলিলের ফাঁসি দেওয়া উচিত ছিল। রায় ঘোষণার পর আসামি পক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন এবং আপিলের পর সাজাপ্রাপ্তদের চার জনের জামিন হয়ে যায়।
    এতে আবারও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন পূর্ণিমা ও তার পরিবার। পরে অ্যাটর্নর্ি জেনারেল মাহবুবে আলমের আন্তরিক সহযোগিতায় জামিন বাতিল হয় এবং তাদের নতুন করে গ্রেফতার করে পুলিশ বলে জানায় পুর্নিমা ।
    চরম দুর্দিনে পূর্ণিমার পাশে দাঁড়ানো উল্লাপাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার খোরশেদ আলম বলেন, সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ পূর্ণিমা উল্লাপাড়ার গৌরব। একজন নারী হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সে। পূর্ণিমা একদিন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অনেক বড় হবে। তিনি আরও জানান, পূর্ণিমা ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী মেয়ে। সে হাজারো নির্যাতন সয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে সত্যের পথে।
    সম্প্রতি পূর্ণিমা শীলকে নিয়ে একটি মিনি ডকুমেন্টারি প্রচার করে বিবিসি, যেখানে ফুটে আসে এত বছর পরেও কিভাবে সমাজের চোখে \”নষ্টা\”, \”অপবিত্র\” হিসেবে গণ্য হওয়ার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে পূর্ণিমা!

    Comments

    comments

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    হাতির মতো এক গরু

    ২৮ আগস্ট ২০১৭

    আর্কাইভ

  • ফেসবুকে চিনাইরবার্তা.কম