• শিরোনাম

    হজের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা

    | মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট ২০১৬

    হজের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা

    বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের সর্বশেষ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দেশব্যাপী চলছে ‘হজ প্রশিক্ষণ কর্মশালা’। এক থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হওয়া এসব কর্মশালা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে অনেক জায়গায়। হজের সঠিক নিয়ম-কানুন হাতে-কলমে শেখানোই কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য। রাজধানীর একাধিক প্রশিক্ষণ শিবির ঘুরে দেখা গেছে, হজের বাহ্যিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয় কীভাবে- এসব বিষয়ের ওপর চলেছে কর্মশালাগুলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে দেশের অন্যান্য প্রশিক্ষণ শিবিরেও হজের বাহ্যিক কর্মকাণ্ডই গুরুত্ব পেয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, কর্মশালাগুলোয় হজের শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা শেখানো এবং জানানো হয় না। ফলে হাজীরা কাবার অলিগলি ঘুরে আসা এবং নির্দিষ্ট কিছু কাজ শেষ করাকেই হজ ভেবে নিয়েছেন। শনিবার সকালে বায়তুল মোকাররমে হজ প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন এমন একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম, হজ শব্দের অর্থ কী? হজ কাকে বলে? উত্তর এসেছে- হজ হল মক্কা-মদিনায় গিয়ে তাওয়াফ ও জেয়ারত করা, শয়তানকে পাথর মারা, জমজমের পানি পান করা, ইত্যাদি। এসব উত্তর শুনে বললাম, এক জীবনে কতবার কাবা জেয়ারত করতে পারবেন বলে মনে করেন? ‘একবার’ উত্তরটাই ছিল বেশি সংখ্যক হাজীর। বললাম, আবু জাহেল, আবু লাহাবরা তো সহস্রবার কাবা জেয়ারত করেছে। তাহলে তো তারা আপনার আমার চেয়ে বড় হাজী। প্রকৃত অর্থে হজ হল- সাদা কাফনে নিজেকে পেঁচিয়ে বাইতুল্লাহর কালো রঙের স্পর্শে ধূসর-শুষ্ক আত্মাকে সজীব করা এবং দুনিয়ার রঙিন জীবন ছেড়ে প্রেমের অশ্রু ঝরিয়ে মুত্তাকি জীবনের শপথ নেয়া। কোরআনের পরিভাষায় একেই হজ বলে। হাদিসে বর্ণিত ‘হজে মাবরুর’ তথা খোদার কাছে গৃহীত হজ এটিই।

    রাজধানীর যাত্রাবাড়ী জুরাইনে মসজিদ-মাদ্রাসার পাশাপাশি হজ কাফেলাগুলোও একাধিক প্রশিক্ষণ শিবির করেছে। প্রায় পাঁচটি শিবিরে প্রশিক্ষণ দেন এমন একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভবিষ্যৎ হাজীদের হজের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা কী তা জানিয়েছেন? সম্ভবত এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। বললেন, এত বছর হজ প্রশিক্ষণ দিচ্ছি এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হইনি কখনও। এখন থেকে ভাবব। আরেকজন প্রশিক্ষকের কাছে জানতে চাইলাম, জামারায় পাথর মারার শিক্ষা কী? অনেকে মনে করেন, এখানে শয়তানকে বেঁধে রাখা হয়েছে। শয়তানকে পাথর মেরে হজ সম্পন্ন করলে জীবনের সব পাপ মাফ হয়ে যাবে- এসব ধারণার বাস্তবতা কতটুকু? বিজ্ঞ প্রশিক্ষক বলতে শুরু করলেন- ‘জামারায় শয়তান বাঁধা আছে, এ ধারণা মোটেও সঠিক নয়। শয়তানকে যদি বেঁঁধেই রাখা হয়, তাহলে বিশ্বব্যাপী শয়তানের রাজত্ব চলছে কীভাবে? যে হাজী শয়তানকে পাথর মেরে হজ সম্পন্ন করলেন তিনি দেশে ফিরে কীভাবে শয়তানের প্রতিনিধিত্ব করেন? প্রকৃত ঘটনা হল আল্লাহর নবী ইবরাহিম (আ.) ইসমাইল (আ.) কে নিয়ে কোরবানি করতে গেলে এ পথে শয়তান তাদের ধোঁকা দেয়। এখানে শয়তানের প্রতিকৃতি বানানো হয়েছে যাতে করে মানুষ শয়তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে পারে। পরবর্তী জীবনে শয়তান ধোঁকা দিতে চেষ্টা করলেই যেন তাকে পাথর ছুড়ে খোদার দরবারে ‘লাইব্বাইক আল্লাহ’ বলে হাজিরা দিতে পারে। আফসোস, তাকওয়ার প্রশিক্ষণপূর্ণ হজকে আমরা অনুষ্ঠান সর্বস্ব হজ বানিয়ে নিয়েছি।

    কুমিল্লা থেকে আসা কয়েকজন হজযাত্রীর সঙ্গে কথা হয় বায়তুল মোকররমের উত্তর গেটে। জানতে চাইলম, সাফা মারওয়ার সায়ীর বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন? সবাই বললেন, হু। নিয়েছি। বললাম, এখানে দৌড়ালে খোদার কী লাভ আর খোদার সৃষ্টিরই বা কী লাভ? একজন বলে উঠল সাবধানে কথা বলেন। এগুলো আল্লাহর নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন। আর যে ব্যক্তি আমার প্রেমঘরে হজ কিংবা ওমরা করবে তার জন্য এ পাহাড়দ্বয়ে দৌড়ানোয় কোনো গুনাহ নেই। (সূরা বাকারাহ ২ : ১৫৮।)’ সুতরাং আদব রেখে কথা বলুন। আমি বললাম, সাফা মারওয়ার ইতিহাস জানেন? ভদ্রলোক বললেন, পানির পিপাসায় ইসমাইল (আ.)-এর প্রাণ ওষ্ঠাগত দেখে বিবি হাজেরা পানির খোঁজে এ পাহাড়দ্বয়ে দৌড়েছিলেন। আল্লাহর কাছে এটি খুবই পছন্দ হয়েছে। তাই আল্লাহতায়ালা হজের জন্য এ কাজটি আবশ্যক করে দিলেন। কথার পিঠে বললাম, পানির পিপাসায় একজন মানুষ মারা যাচ্ছে, আরেকজন পিপাসার্ত নারী ওই মানুষকে বাঁচানোর জন্য নিজের দুর্বল দেহ নিয়ে পরপর সাতবার দৌড়ালেন, তিনি হয়তো জানতেন এভাবে দৌড়ালে পানি পাওয়ার চেয়ে নিজের তেষ্টাও বেড়ে যাবে। অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার এ ইতিহাস যেন মানুষ ভুলে না যায় এবং যুগে যুগে মা হাজেরার মতোই যেন প্রত্যেক মুমিন অন্যের সাহায্যে ব্যাকুল থাকে- তাই আল্লাহতায়ালা সাফা মারওয়ায় দৌড়ানোকে নিজের নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। সাফা মানে পরিশুদ্ধ হওয়া, সাফ হওয়া। আর মারওয়া মানে মানবতা। মানুষের প্রতি দরদি না হয়ে যতই হজ আর সায়ী করা হোক তা কখনও আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না এবং এ হজ কখনই আপনাকে গুনাহ থেকে পরিশুদ্ধ করবে না। কুমিল্লার এই ছোট্ট কাফেলাটি সাফা মারওয়ার এ ব্যাখ্যা শুনে যারপরনাই অবাক হলেন। বললেন, এত সুন্দর মানবতার কথা তো আমাদের কখনও বলা হয়নি।

    কাবার অলিগলি ঘুরলে আর নির্দিষ্ট কিছু কাজ করলেই হজ হয় না। পংকিল জীবন থেকে ফিরে এসে মুত্তাকি জীবনের শপথ নেয়ার নামই প্রকৃত হজ। এ শপথ নিতে না পারলে যত নিখুঁতভাবেই হজের কার্যক্রম সম্পাদন করুন না কেন পবিত্র কোরআনের আলোকে আপনার হজ হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মুখ পূর্ব দিকে বা পশ্চিম দিকে ফিরানোর মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বরং খোদার কাছে প্রকৃত কল্যাণকর কাজ হল ফেরেশতা, আল্লাহর কিতাব এবং নবীদের মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা এবং খোদার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রাণপ্রিয় সম্পদ থেকে আত্মীয়স্বজন, এতিম, নিঃস্ব, পথিক ও সাহায্য প্রার্থীদের জন্য ব্যয় করা। (সূরা বাকারাহ ২ : ১৭৭।) মানবতার কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করার নামই হজ। অথচ আমাদের হাজীদের জীবনে মানবতার চর্চা ও শিক্ষা নেই। হজ প্রশিক্ষক এবং হজযাত্রীদের উদ্দেশে অনুরোধ করছি- হজের বাহ্যিক নিয়ম-কানুনের পাশাপশি হজের গূঢ় রহস্য এবং প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানুন এবং জানান। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে কোরআনে আঁকা হজ আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।

    Comments

    comments

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    আর্কাইভ

  • ফেসবুকে চিনাইরবার্তা.কম