| বুধবার, ১৩ জুলাই ২০১৬
রমজান মাসের আসন যেমন বছরের সব মাসের মাথায় তেমনই শবেকদরের আসন রমজান মাসের মাথার ওপর। তাই এ রাত শুধু মালিক মাওলার আর প্রেমিক বান্দার। শবেকদরে মাওলা মাবুদ তার সর্বোচ্চ মায়া-মমতা এবং ক্ষমতার ডালিখানি মেলে ধরেছেন জিন্দা কোরআন আখেরি নবী হুজর পাকের রূহ আর আক্ষরিক নবী কোরআনুল কারিমের বাহ্য সুরত নাজিলের মাধ্যমে। আউলিয়া কেরাম শবেকদর তথা সব ক্ষমতাধরের প্রেম পসরা বণ্টনের রাতকে সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামতের ফজর তক মহাকালকে মনে করেন। আর এ আসমানে আহমদী ও জমিনে মুহাম্মদী রজনীর মাঝেই মাশুকে মুতলাক তথা চূড়ান্ত প্রেমিকা হকতায়ালা গোপন থেকে প্রতিটি বিষয়ে, প্রতিটি জীবে ও অণু-পরমাণুতে মালাইকা এবং মহামহিম একক রূহের মাধ্যমে সৌভাগ্য বিলিয়ে যান। আর এ রব্বানি মমতা ও ক্ষমতা সালাম রূপে সমানে প্রবাহিত থাকছে ও থাকবে সেই মাওলা মাবুদ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর প্রকাশের ফজর পর্যন্ত। তাই তো এ মহাপ্রলম্বিত শক্তিময় রাতের অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন সোজা কথা নয়। ওমা আদরা কা মা লাইলাতুল কাদর বুঝবে না, বুঝবে না তুমি এ প্রেমময় ও শক্তিধর রাতের মহিমা ও মূল্য! দিওয়ানে শামসে তাবরিজিতে তাই আমাদের মাজহাবে ইশকের পীরানে পীর মাওলানা রুমী আমাদের দান করেছেন একটি নসিহত পূর্ণ প্রেমময় গজল। এ ঐশী প্রেম গীতিতে তিনি যা বলেছেন তার সরল-সহজ অনুবাদ পেশ করছি লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য, মহিমা ও রূহানি শক্তিকামী রোজাদার পাঠকদের সামনে। হজরত মাওলানা রুমী লিখেছেন :
‘নিদ্রায় যেও না একটি রাত হে সোনা!
যা চাও তুমি সর্বাধিক তা এসে যাবে তোমার কাছে!
এক অন্তরে সূর্যের উত্তাপ ভরা কত।
বিস্ময়কর বিষয়াদি দেখতে পাবে তুমি।
আজ এ কদরের রাতে তোমার মাথা রেখ না শিয়রের ওপর।
দৃঢ় হও, শক্তি এসে যাবে তোমার মাঝে
যত সাজসজ্জা তা আসবে রাতে।
যারা ঘুমিয়ে পড়বে তারা হয়তো তা হারাবে।
এক রাতে মুসা জেগেছিলেন এবং কামনা করেছিলেন আর দেখেছিলেন একটি আলো এক গাছের মাঝে।
অতঃপর তিনি রাতে হাঁটলেন দশ বছরের পথ। অবশেষে দেখলেন সমগ্র বৃক্ষটি আলোতে উদ্ভাসিত। মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বোরাকে সওয়ার হলেন রাতের আকাশে মেরাজে- একটি মাত্র রাত ও লগ্নে। দিন তো কাজ ও রুজির জন্য। আর রাত কেবলই ইশকের-প্রেমের। কেউ যেন তোমাকে দেখে না ফেলে। অনেকেই তো ঘুমিয়ে কাটায় রাত। শুধু প্রেমিকরাই জেগে কাটান। অন্ধকারে তারা মোরাকাবায় বসেন এবং প্রেমালাপ করেন, কিসসা শুনান ফিসফিস খোদাকে। দয়ালু খোদা বলেছেন কথা দাউদের সঙ্গে, ‘যারা প্রতিটি রাত কাটিয়ে দেয় ঘুমে এবং দাবি করে আমাদের সঙ্গে রয়েছে সংযুক্ত, তারা তো মিথ্যাবাদী।’
আশেকগণ ঘুমাতেই পারেন না যখন তারা অনুভব করেন তাদের চারপাশে প্রেমময়ের বিচরণ একাকী সংগোপনে! তার সঙ্গে যে তখন প্রেমিকের চলে মনের কথা, বিরহ-বেদনার কাহিনী।
কারো পিপাসা ক্ষণিকের জন্য ঘুমিয়ে পড়তে পারে বটে, কিন্তু সে স্বপ্ন দেখবে সুরাহি ভরা পানি ঝর্ণার পাশে। কিংবা কোনো ব্যক্তির হাত থেকে তুমি পেয়ে যাবে আধ্যাত্মিক পানীয়।
সারা রাত হকতায়ালার কাছ থেকে আসে প্রেমের আহ্বান। হে সম্বলহীন! দাঁড়াও, জেগে কাটাও এ রাত। গনিমত মনে করো এ রজনীর সুযোগ।
নইলে মউতের পর তোমার ভাগে থাকবে শুধু আফসোস। যখন দেহ থেকে প্রাণ পাখি বের হয়ে যাবে আশেক-মাশুক যুগল হয়ে যাবে জুদা। দেহ জমিনে পড়ে রইবে বেহুদা- কেবল কণ্টক আর আগাছায় ভরা।
আমি তো তোমার নাগালের বাইরে আমি বেহুশ বেকারার- চিনিনে নিজেরই হাত-পা ও মাথা।
হে তাবরিজের গৌরব আল্লাহর সূর্য শামসে তাবরিজ!
এবার আমি ঠোঁট চেপে রাখলাম, তুমি এসো, খুলে দাও আমার মুখ!’
আসলে কোরআনের রাত, মালাইকার রাত, দয়াল নবীর রাত এবং পরম প্রিয়তম রবের রাত লাইলাতুল কদরের প্রেমময় আমল তথা জিক্র, ফিক্র ও মাবুদের সঙ্গে ইশকের সালাত নিয়ে আলে মুহাম্মদ ও আউলিয়া কেরাম অনেক নিয়মই উপহার দিয়েছেন বান্দাদের জন্য। মাওলা মাবুদের রাত জাগা বন্দেগির মাধ্যমে বান্দা পরম প্রিয়তম বন্ধুতে পরিণত হওয়ার অবারিত সুযোগ লাভ করেন এই শবেকদরে- শক্তি বণ্টন ও অর্জনের সর্বোত্তম রজনীতে। পরম কল্যাণ তথা সালাম নসিব হোক আমাদের সবার। প্রতিটি মানুষ প্রতিটি প্রাণী ও অণু-পরমাণু সবাই সালামের ভাগ পেয়ে ধন্য হোক।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস